হরপ্পা সভ্যতার ধ্বংসের বা পতনের কারণ ?

 হরপ্পা  সভ্যতা ধ্বংসের কারণ আলোচনা কর।


 আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে সিন্ধু নদের অববাহিকায় যে উন্নত সভ্যতা গড়ে উঠেছিল তার নামই হলো সিন্ধু সভ্যতা বা হরপ্পা সভ্যতা। কারণ আগেকার দিনে যে কোন সভ্যতায় কোন নদবা নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। কেমন উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি মিশর সভ্যতা গড়ে উঠেছিল নীল নদকে কেন্দ্র করে মিশরীয় সভ্যতা গড়ে উঠেছিল তাই ইউক্রেটিস নদীকে কেন্দ্র করে, আর ঠিক সেরকম ভাবেই সিন্ধু নদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল সিন্ধু সভ্যতা, অর্থাৎ সিন্ধু নদীর তীরে এই সভ্যতা গড়ে উঠেছিল বলে এর নাম হয়েছিল সিন্ধু সভ্যতা। এই সিন্ধু সভ্যতা বা হরপ্পার সভ্যতার আবিষ্কার হয়েছিল লিওনেসিক যুগে।এই সভ্যতা গড়ে ওঠার আগে পর্যন্ত ভারতীয় সভ্যতা বা  সংস্কৃতিকে কোন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতার আবিষ্কার এই ভ্রান্ত ধারণার অবসান ঘটিয়েছিল। ভারতবর্ষ যে এক উন্নত সভ্য সাংস্কৃতিক পূর্ণ দেশ সেটা আজ অস্বীকার করার কোন জায়গায় নেই। এই সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য গুলি আজও দাদা মনোবিজ্ঞানী ছাত্র ছাত্রীদের কাছে একটি বিষ্ময়। এই সিন্ধু সভ্যতা ছিল প্রধানত একটি নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা। কোন কোন সমাজবিজ্ঞানের মতে এই সিন্ধু সভ্যতা বিকাশের পূর্বে এই অঞ্চলের ভোলান গিরিপথ এর কাছে মেহেরগড় অঞ্চলের কৃষি সম্প্রদায়ের বসবাস গড়ে উঠেছিল। কিন্তু পরে তারা এই অঞ্চল এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চল যেমন সিন্ধু প্রদেশ,রাজস্থান,বেলুচিস্তান, প্রভৃতি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। বর্তমানে গুজরাটের লোথাল পর্যন্ত এই সভ্যতা বিকাশে নিদর্শন পাওয়া গেছে। কৃষি, বাণিজ্য দেশে ও দেশের বাইরে সুন্দর  নিকাশি ব্যবস্থা ধর্ম সংস্কৃতি প্রভৃতি এই সভ্যতা উন্নত হলেও, এই সভ্যতা শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে নি। চিরস্থায়ী হয়নি এই সভ্যতা। বিভিন্ন পন্ডিতেরা সিন্ধু সভ্যতা পতনের জন্য বিভিন্ন কারণ কে দায়ী করেছেন।


 অভ্যন্তরীণ অবক্ষয়ের ফলে  সিন্ধু সভ্যতার পতন :-


 সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসের পেছনের প্রধান কারণ ছিল অভ্যন্তরীণ অবক্ষয়। ধ্বংসাবশেষ থেকে দেখা যায় যে নগরটি সাতবার ধ্বংস হয়েছিল ও সাতবার নতুন করে তৈরি হয়েছিল। এবং আনুমানিক ২০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এই নগরটি সম্পূর্ণ  ভাবে ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। হরপ্পা সভ্যতার অবক্ষয় দীর্ঘদিন ধরে চলছিল। বিভিন্ন জায়গার নাম খনন কার্যের ফলে এই সভ্যতার অবক্ষয় দেখা দেয়। মহেঞ্জোদারো সহ অন্যান্য শহরগুলিতে জনস্ফিতি  ঘটার ফলে বড় বড় বাসস্থান গুলি ধীরে ধীরে ছোট হতে শুরু করে। এমনকি সেগুলি রাজপথের উপরেও নেমে আসে। সিন্ধু সভ্যতার পতনের কারণকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিভিন্ন পন্ডিতেরা অনেক বিভিন্ন বিষয়গুলি তুলে ধরেছেন। মহেঞ্জোদারো হরপ্পা কালিবঙ্গান প্রভৃতি অঞ্চলগুলিতে ক্রমশ নগর পরিকল্পনা গৃহ নির্মাণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। আর বলে সিন্ধু সভ্যতার প্রধান প্রধান অঞ্চল গুলি থেকে জনগণ অন্যত্র চলে গিয়েছে। তবে এ কথা ঠিক নয় জনগণের বসবাস একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। তারা ক্রমশ অন্যত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রধানত সিন্ধু সভ্যতা পতনের জন্য দুটি কারণ লক্ষ্য করা যায়। এক সম্ভবত কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এই সভ্যতার পতন ঘটেছিল। দ্বিতীয় টি হল  বহিরাগত কোন শত্রু আক্রমণ করেছিল আর এই সভ্যতার পতন ঘটিয়ে ছিল।

 

গাছপালা কেটে ফেলা :- এর পরবর্তী কারণ হিসেবে পন্ডিতেরা বলেছেন গাছপালা কেটে ফেলা একদিকে মালভূমির প্রসার অপরদিকে হরপ্পার লোকজনেরা ইট পোড়ানোর জন্য গাছপালা যথেষ্ট ভাবে কাটতে শুরু করেছিল। তলে এই অঞ্চল ধীরে ধীরে বন্য শূন্য হতে শুরু করে এবং কৃষি অর্থনীতির বিপর্যয় ঘটে। কি পরিচিতির অবনতি ঘটতে থাকার ফলে মানুষজন এই জায়গা ছেড়ে অন্যত্র জায়গায় চলে যেতে শুরু করে।


 প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসের কারণ :-


 কিছু কিছু ঐতিহাসিক বলেছেন হরপ্পা সভ্যতার অবনতির মূলে রয়েছে প্লাবন অর্থাৎ বন্যা মহামারী এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ। টিক পরিবেশের পরিবর্তন হরপ্পার সভ্যতার একটি অন্যতম কারণ। অন্যান্য প্রাকৃতিক কারণ এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক কারণ হলো জমিতে লবণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া। সম্প্রসারণ হয়েছিল এবং সিন্ধু নদের গতিপথের পরিবর্তন হয়েছিল। জল বিজ্ঞান বিষয়ের ব্যাপক গবেষণা করে জানা গেছে কাছে এক ভয়াবহ ভূমিকম্প ঘটেছিল। এর ফলে নগরটি সম্পন্নরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। সম্প্রীতি অভিজ্ঞান সম্পন্ন গবেষকদের মধ্যে থেকে জানা যায় ২২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ ব্রোঞ্জ যুগে সভ্যতার কেন্দ্রগুলিতে নানান ভৌগোলিক পরিবর্তন ঘটেছিল।অভ্যন্তরীণ দিক দিয়ে বলা হয়েছে বা অনুমান করা হয়েছে যে মহেঞ্জোদারো কমপক্ষে তিনবার প্লাবিত হয়েছিল অর্থাৎ বন্যা হয়েছিল। মহেঞ্জোদারোতে পড়া পলি ভেঙে যাওয়া বালির স্তর ব্যাপক ও বিভিন্ন বন্যার স্বাক্ষর বহন করে। জন্যই নিতত্ত্ববিধ পুরাতন তত্ত্ববিদরা অনুমান করেছেন যে বারবার ব্যাপক বন্যা এই সিন্ধু সভ্যতা কে গ্রাস করেছে।


 বহিরাগত শত্রুর আক্রমণ  সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের কারণ :-


 কিছু কিছু ঐতিহাসিক বলেছেন উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে নানারকম বিদেশী শক্তির আক্রমণের ফলে এই সভ্যতা বিনাশ ঘটেছিল। প্রসঙ্গে তারা আর্যদের অভিযানের কথা উল্লেখ করেছেন। ঋকবেদে বর্ণিত বৈদিক ঘটনার উল্লেখ করে আর্যদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর আক্রমণের ফলে সিন্ধুদের বহু নগর গুলি বিলুপ্ত হয়ে যায়। মার্টিন মার হুইলার প্রমুখরা এই ধরনের মন্তব্য করেছে যে, সিন্ধু সভ্যতা আর্যদের দ্বারা আক্রমণ হয়েছিল এবং তার ফলেই এই সভ্যতার ধ্বংস হয়েছিল। বলা হয় যে মহেঞ্জোদারো সভ্যতার শেষের দিকে গণহত্যা নিদর্শন ও পাওয়া গেছে। শহরের বিভিন্ন রাস্তায় নর কঙ্কালের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। তার ফলে ১৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ মহেঞ্জদারো জনশূন্য হয়ে পড়েছিল। আর এইদিকে আর্যরা ১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে নাগাদ ভারতে প্রবেশ করেছিল। আবার এর ফলেও প্রমাণ হয় না যে মহেঞ্জোদার বৈদেশিক আক্রমণের প্রভাবে ক্রমশ পতনের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল।


 প্রাকৃতিক পরিবেশ সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের কারণ :-


আবার অনেক ঐতিহাসিকের মতে মহেঞ্জোদারো হরপ্পা সভ্যতার পতনের জন্য প্রাকৃতিক পরিবেশ দায়ী ছিল। কারণ তারা মনে করেন ক্রম বর্ধমান জনসংখ্যা এবং পশু পাখি দিয়ে পরিবেশকে দূষিত করে তুলছিল। অন্য সবুজ অঞ্চল দিন দিন বিদায় নিচ্ছিল। এর ফলে জায়গায় জায়গায় এসেছিল বন্যা আর খরা। আর এর ফলে ক্রমশ সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু একথা বলা যায় যে পরবর্তী সময়ে ভারতে তথা  সিন্ধু সভ্যতার অঞ্চলের যে উর্বর মাটি পাওয়া গিয়েছিল তাতে এই কারণটি ভুল প্রমাণিত হয়ে গেছিল। হকারা নদীর শুকিয়ে যাওয়ার ফলে অনেকের মতই সিন্ধু সভ্যতার পতন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। এছাড়াও আর্যদের অন্যতম একটি প্রাচীন গ্রন্থ হলো ঋকবেদ। সেই ঋকবেদে উল্লেখিত আছে যে, অনার্যদের শহর ধ্বংস করা হয়েছিল। এমনকি হরি ও প্রিয়া যুদ্ধের উল্লেখ করা হয়েছে। অনেকে এই হরিয়া অঞ্চল কে হরপ্পা সভ্যতার সাথে তুলনা করেছেন। আবার অনেকে এই ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।


  এই হরপ্পা সভ্যতা আমাদের যে যে বিষয়গুলিকে স্মরণ করিয়ে দেয়:-


এই হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতা আমাদের কয়েকটি বিষয়কে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, এই সভ্যতার নাগরিক বৈশিষ্ট্য কয়েক কতকগুলি পরস্পর পরস্পরকে পর জড়িয়ে থাকা সম্পর্কের ভিত্তিতে নির্ভরশীল ছিলএই সম্পর্ক। সম্পর্কগুলোর উপাদান বা ভিত্তি ছিল নগর বা গ্রাম। কৃষি সম্প্রদায় বা যাযাবর গোষ্টির মধ্যে এক ভারসাম্য রক্ষার অথবা পরিবেশ রক্ষার এক উপাদান। অথবা এই সভ্যতার টিকে থাকার আশেপাশের সাময়িক সভ্যতার সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক একটি অন্যতম কারণ হিসেবে ধরা হয়। কারণ বাণিজ্যের জন্য প্রয়োজন ছিল বিভিন্ন ধাতুর এবং আশেপাশের অঞ্চল গুলি থেকে এমন কি ভারতের বাইরে মেসোপটেমিয়া থেকেও সংগ্রহ করা হতো। এই চলতেই এমন একটা সময় এল বসের বাইরে বা অভ্যন্তরে সিন্ধু সভ্যতা অঞ্চলের উন্নত সভ্যতার অস্তিত্বের জন্য এই ভারসাম্য বা সুস্থ সম্পর্ক ভেঙে পড়েছিল। তার ফলে অভ্যন্তরীণ অবক্ষয  বা প্রাকৃতিক বিপর্যয় অথবা বৈদেশিক আক্রমণ ও ভাই সেই সময় সিন্ধু সভ্যতার পতনের জন্য দায়ী ছিল। এই সিন্ধু সভ্যতার পতন ঘটেছিল একথা যেমন সত্য তেমনি একটি নির্জলা সত্য এই যে আমাদের পরবর্তীতে সভ্যতার বিকাশ নানান দিক থেকে এই সিন্ধুর সভ্যতার কাছে ঋণী।


Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top