সালোকসংশ্লেষ এবং শ্বসন
বন্ধুরা আপনারা হয়তো সবাই জানেন যে আমরা এই পৃথিবীতে কিভাবে বেঁচে আছে এবং আমাদের পরিবেশে এত অক্সিজেন কিভাবে উৎপন্ন হয়। তো বন্ধুরা এর প্রধান কারণ হলো উদ্ভিদের অস্তিত্ব। আমাদের এই পৃথিবীতে জীবজগতের প্রথম আবির্ভাব উদ্ভিদ। উদ্ভিদরা সর্বপ্রথম সূর্যালোকের শক্তি সংগ্রহ করে বেঁচে থাকার কৌশল তৈরি করে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখে। সবুজ উদ্ভিদ সৌরশক্তিকে সালোকসংশ্লেষের মাধ্যমে স্থৈতিক শক্তিরূপে প্রথমে গ্লুকোজ এবং পরে অন্যান্য কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট প্রভৃতি জৈব যৌগে আবদ্ধ করে। এইসব জৈব যৌগের মূল উপাদান হল কার্বন, যা মূলত বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইড থেকে গৃহীত হয়। এই জৈব যৌগ উদ্ভিদরা খাদ্যরূপে গ্রহণ করে পুষ্টি, বৃদ্ধি, জনন প্রকৃতি নানান শরীরবৃত্তীয় জীবনক্রিয়া সম্পন্ন করে। তাই বলতে হয় সৌরশক্তি সকল শক্তির মূল উৎস।
সবুজ উদ্ভিদ সৌরশক্তিকে খাদ্য তৈরি সময় খাদ্যের মধ্যে স্থৈতিক শক্তিরূপে আবদ্ধ করে, শ্মশানকালে খাদ্য জড়িত হয়ে খাদ্যস্ত স্থৈতিক শক্তি তাপ শক্তি ও গতিশক্তিরূপে মুক্ত হয়। সুতরাং জীবদেহে বিভিন্ন প্রকার শারীরবৃত্তি ও কার্য সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ করাই শ্বসনের একমাত্র উদ্দেশ্য। তো বন্ধুরা সালোকসংশ্লেষ এবং শ্বসন জৈবিক প্রক্রিয়া দুটি পরস্পর পরস্পরের উপর নির্ভরশীল এবং বিপরীতমমুখী।
সালোকসংশ্লেষের সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা–
1898 খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী বার্নেস ‘সালোকসংশ্লেষ’ বা ‘ফোটোসিন্থেসিস’ শব্দটি সর্বপ্রথম প্রচলন করেন, যা
গ্রিক শব্দ ফোটোস অর্থাৎ আলো এবং সিন্থেসিস অর্থাৎ সংশ্লেষ এর ওপর গঠিত। আলোর উপস্থিতিতে কোন কিছুর সংশ্লেষকে সালোকসংশ্লেষ বলে। ক্লোরোফিল এটি অতি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস সালোকসংশ্লেষণ। সবুজ উদ্ভিদ মাথা কিংবা সবুজ অংশে ক্লোরোফিল দ্বারা সৌরশক্তিকে গ্রহণ করে পরিবেশ থেকে জল ও কার্বন ডাই-অক্সাইডের সাহায্যে শর্করা জাতীয় খাদ্য প্রস্তুত করে। চালকসংশ্লেষের সূর্যালোকের উপস্থিতিতে এবং ক্লোরোফিলেরসক্রিয়তাই জল এবং কার্বন ডাই অক্সাইডের রাসায়নিক বিক্রিয়ায় পাতার ক্লোরোফিল যুক্ত কোষে উৎপন্ন হয় সরল শর্করা বা গ্লুকোজ।
সালোকসংশ্লেষের সংজ্ঞা–
যে শরীর ভিত্তিক প্রক্রিয়ায় ক্লোরোফিল যুক্ত কোষের সূর্যালোকের উপস্থিতিতে এবং ক্লোরোফিল এর সাহায্যে পরিবেশ থেকে শোষিত জল ও কার্বন ডাই অক্সাইডএর রাসায়নিক বিক্রিয়ায় সরল শর্করার সংশ্লেষিত হয় এবং উৎপন্ন খাদ্যে সৌরশক্তি আবদ্ধকরণ ঘটে এবং উপজাত বস্তু রূপে জল ও অক্সিজেন উৎপন্ন হয়, তাকে সালোকসংশ্লেষ বা ফটোসিনথেসিস বলে। অনেকে আবার সালোকসংশ্লেষ কে অঙ্গার আত্তীকরণ বলেছেন।
সালোকসংশ্লেষ কে কেন আঙ্গার আত্তীকরণ বলে?
সালোকসংশ্লেষের সময় বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের কার্বন অর্থাৎ অঙ্গার গ্লুকোজ অনুতে অঙ্গীভূত হয় বলে সালোকসংশ্লেষ কে অঙ্গার আত্তীকরণ বা কার্বন অ্যাসিমিলেশন বলে।
সালোকসংশ্লেষ ও অঙ্গার আত্তীকরণের পার্থক্য–
সালোকসংশ্লেষ ও অঙ্গার আত্তীকরণ এর মধ্যে প্রধান পার্থক্য গুলি হল –
1. সালোকসংশ্লেষ আলোক নির্ভর প্রক্রিয়া। – অঙ্গার আত্তীকরণ আলোক নিরপেক্ষ প্রক্রিয়া।
2. সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়া টিক ক্লোরোফিল এর উপস্থিতিতে ঘটে। – অঙ্গার আত্তীকরণে ক্লোরোফিল অংশগ্রহণ করে না।
3. সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় সৌরশক্তি ব্যবহৃত হয়ে গ্লুকোজ উৎপন্ন হয়। – অঙ্গার আত্তীকরণ প্রক্রিয়ায় সৌরশক্তি ব্যবহৃত হয় না, তবে জৈব অ্যাসিড সংশ্লেষিত হয়।
4. সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় অক্সিজেন নির্গত হয়। – অঙ্গার আত্তীকরণ প্রক্রিয়ায় অক্সিজেন নির্গত হয় না।
5. সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় শক্তি উৎপন্ন হয়। – অঙ্গার আত্তীকরণ প্রক্রিয়ায় শক্তি উৎপন্ন হয় না।
সালোকসংশ্লেষ কে উপচিতি বিপাক বলা হয় কেন?
বন্ধুরা আপনারা অনেকে হয়তো জানেন না অনেক বিজ্ঞানীরা সালোকসংশ্লেষ কে উপচিতি বিপাক বলেও চেনে। উপচিতি বিপাক কথার অর্থ হল, যে প্রক্রিয়ায় জীবদেহের খুব সামান্য ওজন বৃদ্ধি পায়, তাকে উপচিতি বিপাক বলে। সালোকসংশ্লেষে উৎপন্ন গ্লুকোজ উদ্ভিদ দেহের খুব সামান্য মাত্রায় ওজন বৃদ্ধি ঘটায় বলে সালোকসংশ্লেষ কে উপচিতি বিপাক বলে।
সালোকসংশ্লেষ সম্পর্কে বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের অবদান
বন্ধুরা সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়াটি কেবলমাত্র বিজ্ঞানী বার্নেস আবিষ্কার করেননি। আরো অনেক বিজ্ঞানী এই প্রক্রিয়ার সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। যেমন-
1. বিজ্ঞানী ‘J. B. Van Helmont’ 1648 খ্রিস্টাব্দে প্রমাণ করেন যে, উদ্ভিতরা মাটি থেকে পুষ্টি দ্রব্য এবং জল শোষণ করে খাদ্য প্রস্তুত করে।
2. বিজ্ঞানী ‘Stephen Hales’ 1727 খ্রিস্টাব্দে প্রমাণ করেন যে, উদ্ভিদের পুষ্টি সাধনে পাতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।
3. বিজ্ঞানী ‘Joseph Priestley’ 1772 খ্রিস্টাব্দে প্রমাণ করেন যে, সালোকসংশ্লেষের সময় উদ্ভিদ অক্সিজেন গ্যাস পরিত্যাগ করে।
4. বিজ্ঞানী ‘Jean Senebier’ 1796 খ্রিস্টাব্দে প্রমাণ করেন যে, সালোকসংশ্লেষের সময় উদ্ভিদ কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস শোষণ করে।
5. বিজ্ঞানী ‘Pelletier’ 1818 খ্রিস্টাব্দে উদ্ভিদ-মধ্যস্থ সবুজ বর্ণের রঞ্জক পদার্থকে প্রথম ক্লোরোফিল নামে অভিহিত করে।
6. বিজ্ঞানী ‘Robert Von Mayer’ 1845 খ্রিস্টাব্দে প্রমাণ করে যে, সালোকসংশ্লেষের সময় সৌরশক্তি রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়।
7. বিজ্ঞানী ‘Blackman’ 1905 খ্রিস্টাব্দে প্রমাণ করে যে, সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়াটি আলোক বিক্রিয়া ও অন্ধকার বিক্রিয়া — দুটি পর্যায়ের সম্পূর্ণ হয়।
8. বিজ্ঞানী ‘Samuel Ruben’ and ‘Kamen’ 1941 খ্রিস্টাব্দে প্রমাণ করে যে, তেজস্ক্রিয় অক্সিজেন আইসোটোপ ব্যবহার করে প্রমাণ করে সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন অক্সিজেন জল থেকে উৎপন্ন হয়।
9. বিজ্ঞানী ‘Benson’ and ‘Calvin’ 1954 খ্রিস্টাব্দে প্রমাণ করে যে, ক্লোরেল্লা নামক উদ্ভিদে কেলভিন চক্র পর্যবেক্ষণ করেন।
সালোকসংশ্লেষের স্থান–
ক্লোরোফিল সমন্বিত সকল সজীব কোষে সালোকসংশ্লেষ সংঘটিত হয়। তবে ক্লোরোফিল যুক্ত সবুজ পাতায় উদ্ভিদের প্রদান সালোকসংশ্লেষকারী অঙ্গ। উদ্ভিদের পাতায় অবস্থিত মেসোফিন কলার কোষগুলিতে ক্লোরোফিলের আধিক্য সালোকসংশ্লেষের মাত্রা সর্বাধিক পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু এমন অনেক উদ্ভিদ আছে যাদের পাতা নেই কিন্তু তারা তাদের দেহের সবুজ অংশ দিয়ে সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়া ঘটায়,যেমন- ফনিমনসা, লাউ, কুমড়ো, পুই ইত্যাদি। বন্ধুরা এমনও অনেক প্রাণী আছে যারা সালোকসংশ্লেষ করতে পারে,যেমন- ইউগ্লিনা,ক্সাইস্যামিবা। কিন্তু বন্ধুরা স্বর্ণলতা এবং ছত্রাক এমন দুটি উদ্ভিদ যারা সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়া ঘটাতে পারে না।
সালোকসংশ্লেষের একক–
সবুজ উদ্ভিদ কোষের ক্লোরোপ্লাস্ট বর্তমান। এই ক্লোরোপ্লাস্টএর থাইলাকের পদার্থর মধ্যে থাকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বুটিকার মতো কোয়ান্টাজোম। প্রতিটি কোয়ান্টাজোমএর মধ্যে 250টি
ক্লোরোফিল অনু একসঙ্গে সালোকসংশ্লেষের আলোক রসায়নিক বিক্রিয়াকে স্থায়ীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তাই এদের একত্রে সালোকসংশ্লেষীয় একক বলেন
সালোকসংশ্লষের উপাদানের উৎস এবং তাদের ভূমিকা
সালোকসংশ্লেষে উপাদান গুলির গুরুত্বকে দুই ভাগে ভাগ করা যায় –
1.প্রধান উপাদান- কার্বন-ডাই-অক্সাইড, ক্লোরোফিল, সূর্যালোক এবং জল
2.সাহায্যকারী উপাদান- ADP, NADP+, RuBP*
কার্বন ডাই অক্সাইড – সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় কার্বন ডাই অক্সাইড একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ 0.03 ভাগ। উদ্ভিত প্রাণী শ্বসন, জৈব পদার্থের দহন এবং জৈব পদার্থের বিয়োজন- এর মাধ্যমে পরিবেশে কার্বন-ডাই-অক্সাইড এর নির্দিষ্ট মাত্রা বজায় থাকে। সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় এক অনুপ গ্লুকোজের জন্যে ছয় অনু কার্বন ডাই-অক্সাইড প্রয়োজন হয়। সলদ উদ্ভিদের কার্বন ডাই অক্সাইডের প্রধান উৎস হল বায়ুমণ্ডল, জলদ উদ্ভিদের কার্বন ডাইঅক্সাইডের প্রধান উৎস হল জলে দ্রবীভূত কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বনেট এবং বাইকার্বনেট যৌগ।
সালোকসংশ্লেষের তাৎপর্য –
জীবজগতে জীবনের অস্তিত্ব বজায় রাখতে সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। সমগ্রহ জীবজগৎ অর্থাৎ উদ্ভিদ থেকে শুরু করে প্রাণী কুল এমনকি মানুষ পর্যন্ত সালোকসংশ্লেষের উপর প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল। সৌর শক্তির আবদ্ধ কারণ এবং খাদ্যের মধ্যে এর চৈতি শক্তিতে রূপান্তর – সূর্যই সকল শক্তির মূল উৎস। একমাত্র সবুজ উদ্ভিদরাই পারে সৌরশক্তিকে আবদ্ধ করে বিভিন্ন জৈবিক কাজে ব্যবহার করতেন। সালোকসংশ্লেষের সময় সবুজ উদ্ভিদ সৌর শক্তিকে রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তর করে ATP অনুর মধ্যে আবদ্ধ করে। পড়ে সেই শক্তির উৎপন্ন খাদ্যের মধ্যে পৈতৃক শক্তিরূপে সঞ্চিত হয়। তো বন্ধুরা এই তো সালোকসংশ্লেষ সম্পর্কে আমরা কিছু তথ্য জানলাম তো চলুন জেনে নি এখন শ্মশানের সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্য– যে জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় জীব কোসস্ত খাদ্যবস্তু অক্সিজেনের উপস্থিতিতে বা অনুপস্থিতিতে জারিত হয়ে খাদ্যস্ত তৈতৃক শক্তি গতি শক্তি ও তাপ শক্তিতে রূপান্তরিত ও মুক্ত হয় এবং কার্বন ডাই অক্সাইড ও জল উৎপন্ন করে তাকে শোষণ বলে।।
প্রাণীদের শ্বসন অঙ্গ এবং শাসন পদ্ধতি–
বৈচিত্রময় পরিবেশে প্রাণীদের সাজযন্ত্রের যেমন আলাদা তেমনি শাসন পদ্ধতিও আলাদা। সরল থেকে জটিল বিভিন্ন ধরনেরশ্বাসকৌশল পরিলক্ষিত হয়। অ্যামিবা জাতীয় প্রাণী দেহতল দ্বারা শ্বসন কাজ চালাই। কেঁচো,জোক প্রভৃতি প্রাণী কিউটিকল নামক পাতলা আবরণ দিয়ে ঢাকা ত্বক আদ্র এবং রক্তজ্বালকপূর্ণ। এই রক্তজ্বালকপূর্ণ টক দিয়ে বায়ুমণ্ডল থেকে অক্সিজেন শোষণ করে। তো বন্ধুরা এই ছিল আজকের সালোকসংশ্লেষ এবং শ্বসনের ওপর কিছু অজানা তথ্য।